Blog
অনিদ্রা নারী বা পুরুষের বন্ধ্যাত্ব পর্যন্ত ঘটাতে পারে!

বর্তমান যুগে অনিদ্রা বা ঘুমের অভাব একটি সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা শুধুমাত্র মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে না, বরং প্রজনন ক্ষমতার উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। চিকিৎসাবিদ্যাগত গবেষণাগুলি ইঙ্গিত করে যে, অনিদ্রা নারী ও পুরুষ উভয়ের ফার্টিলিটি হ্রাস করতে পারে।
হাইপোথালামিক-পিটুইটারি-অ্যাডরিনাল (HPA) অক্ষের সক্রিয়তা ও প্রজনন হরমোনের ভারসাম্যহীনতা
অনিদ্রা দীর্ঘমেয়াদে HPA অক্ষের অতিসক্রিয়তা সৃষ্টি করে, যা কর্টিসল ও অ্যাড্রেনোকর্টিকোট্রপিক হরমোন (ACTH) এর মাত্রা বৃদ্ধি করে। এই হরমোনগুলির অতিমাত্রা গনাডোট্রপিন-রিলিজিং হরমোন (GnRH) এর নিঃসরণে বিঘ্ন ঘটায়, ফলে লুটিনাইজিং হরমোন (LH) ও ফলিকল-স্টিমুলেটিং হরমোন (FSH) এর ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়, যা প্রজনন ক্ষমতা হ্রাসের কারণ হতে পারে ।
নারীদের ক্ষেত্রে অনিদ্রার প্রভাব
অনিদ্রা কীভাবে নারীর ডিম্বাণুর মান ও সংখ্যা হ্রাস করে: চিকিৎসাবিদ্যাগত ব্যাখ্যা
অনিদ্রা বা পর্যাপ্ত, গভীর ও নিরবচ্ছিন্ন ঘুমের অভাব শুধু মানসিক চাপের কারণ হয় না—এটি নারীর প্রজনন ক্ষমতার উপরও সরাসরি প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে, এটি ডিম্বাণুর (egg/oocyte) মান ও সংখ্যা (ovarian reserve) হ্রাস করে। নিচে এর কারণগুলো বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:
১. হরমোনাল ভারসাম্যহীনতা
ঘুমের সময় শরীর প্রজনন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ হরমোন তৈরি করে, যেমন:
- GnRH (Gonadotropin-releasing hormone)
- FSH (Follicle-stimulating hormone)
- LH (Luteinizing hormone)
অনিদ্রা এই হরমোনগুলোর নিঃসরণে ব্যাঘাত ঘটায়। ফলে ডিম্বাণু পরিপক্ব হওয়ার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় এবং নিয়মিত ডিম্বস্ফোটন (ovulation) ঘটে না। এর ফলে ডিম্বাণুর মান হ্রাস পায়।
২. সার্কাডিয়ান রিদম ও ওভারিয়ান ফাংশন
ঘুমের অভাব শরীরের সার্কাডিয়ান রিদম বা দেহঘড়ি ব্যাহত করে। এই রিদম প্রজনন হরমোনের নিঃসরণ এবং ওভারি কার্যকারিতা নির্ধারণ করে।
সার্কাডিয়ান ব্যাঘাত হলে:
- ডিম্বাণু তৈরির প্রক্রিয়া সঠিকভাবে হয় না
- ডিম্বাণুর কোষে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বাড়ে
- কোষের DNA ক্ষতিগ্রস্ত হয়
ফলে ডিম্বাণু মানে কমে যায় এবং সময়ের সাথে সাথে ডিম্বাণুর সংখ্যা বা ovarian reserve কমে আসে।
৩. মেলাটোনিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের ঘাটতি
ঘুমের সময় শরীর মেলাটোনিন নামক হরমোন তৈরি করে, যা শুধু ঘুমই নয়, ডিম্বাণুকে রক্ষা করার কাজও করে।
- মেলাটোনিন ডিম্বাণুকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে রক্ষা করে
- এটি follicular fluid-এ থাকে, যা ডিম্বাণুর স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়ক
ঘুম না হলে মেলাটোনিন কমে যায় → ডিম্বাণুর কোয়ালিটি খারাপ হয়।
৪. Cortisol বৃদ্ধি ও স্ট্রেস প্রতিক্রিয়া
অনিদ্রা শরীরে কর্টিসল হরমোন বাড়িয়ে দেয়। কর্টিসলের অতিরিক্ত উপস্থিতি:
- HPA (Hypothalamic-Pituitary-Adrenal) অক্ষকে সক্রিয় করে
- GnRH হরমোনকে বাধাগ্রস্ত করে
- ডিম্বাণু গঠনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে
ফলে হরমোনের স্বাভাবিক কার্যক্রম নষ্ট হয় এবং ডিম্বাণুর সংখ্যা ও মান দুই-ই কমতে থাকে।
গবেষণার ফলাফল
- একটি ২০২৩ সালের গবেষণায় দেখা যায়, ঘুমের মান খারাপ হলে AMH (Anti-Müllerian Hormone) মাত্রা কমে যায়, যা ডিম্বাণুর সংখ্যা কমে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়।
- আরেকটি ক্লিনিক্যাল স্টাডিতে দেখা গেছে, যেসব নারীর ঘুম নিয়মিত খারাপ হয়, তাদের ইনফার্টিলিটির হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
পুরুষদের ক্ষেত্রে অনিদ্রার প্রভাব
অনিদ্রা শুক্রাণুর গুণমান হ্রাস করে: চিকিৎসাবিদ্যাগত বিশ্লেষণ
অনিদ্রা শুধু ক্লান্তি ও মানসিক চাপ সৃষ্টি করে না—এটি পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও ক্লিনিকাল পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, পর্যাপ্ত এবং মানসম্পন্ন ঘুমের অভাব পুরুষের শুক্রাণুর গুণমান (sperm quality) সরাসরি কমিয়ে দেয়। নিচে এর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ দেওয়া হলো:
১. হরমোনাল ভারসাম্যহীনতা
ঘুমের সময় শরীর টেস্টোস্টেরন নামক গুরুত্বপূর্ণ প্রজনন হরমোন নিঃসরণ করে।
অনিদ্রা হলে:
- টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমে যায়
- ফলে স্পার্মাটোজেনেসিস (শুক্রাণু উৎপাদনের প্রক্রিয়া) ব্যাহত হয়
- শুক্রাণুর সংখ্যা, গতি ও আকারে (morphology) পরিবর্তন ঘটে
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে ৬ ঘণ্টার কম ঘুম হলে টেস্টোস্টেরন উৎপাদন ১৫%-২৫% পর্যন্ত হ্রাস পায়।
২. অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বৃদ্ধি
ঘুম ঘাটতির কারণে শরীরে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বাড়ে, অর্থাৎ:
- অতিরিক্ত ফ্রি র্যাডিকেল তৈরি হয়
- শুক্রাণুর DNA ক্ষতিগ্রস্ত হয়
- শুক্রাণুর গুণমান, চলনক্ষমতা (motility) ও সক্ষমতা (viability) হ্রাস পায়
Reactive Oxygen Species (ROS) স্পার্ম সেল মেমব্রেনকে ভেঙে দিতে পারে।
৩. সার্কাডিয়ান রিদমের ব্যাঘাত
শরীরের সার্কাডিয়ান রিদম (Circadian Rhythm) ঘুম ও হরমোনাল নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে।
ঘুমের অভাব এই রিদমে বিঘ্ন ঘটায়, যার ফলে:
- স্পার্ম উৎপাদনের সময় ও হরমোনের সঠিক সমন্বয় নষ্ট হয়
- শুক্রাণুর কোষ বিভাজনে ত্রুটি হয়
- ফলাফল: নিম্নমানের শুক্রাণু
৪. ক্লিনিকাল গবেষণার তথ্য
গবেষণা ১:
Zhang et al., 2016 (Oxford Journal of Human Reproduction):
৯৮০ জন পুরুষের উপর গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের ঘুমের গুণমান খারাপ, তাদের স্পার্ম কাউন্ট, মোটিলিটি ও মর্ফোলজি উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল।
গবেষণা ২:
Taiwan Cohort Study, 2020:
অনিদ্রায় ভোগা পুরুষদের মধ্যে ইনফার্টিলিটির হার ৩৭% বেশি।
৫. মেলাটোনিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হ্রাস
মেলাটোনিন হলো ঘুম নিয়ন্ত্রণকারী একটি হরমোন যা:
- স্পার্ম সেলকে ফ্রি র্যাডিকেল থেকে রক্ষা করে
- ডিএনএ সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে
অনিদ্রা হলে মেলাটোনিনের নিঃসরণ কমে যায় → স্পার্মের সেল মেমব্রেন দুর্বল হয় → কোয়ালিটি নষ্ট হয়।
৬. শুক্রাণু গুণমান হ্রাসের লক্ষণ
- স্পার্ম কাউন্ট কমে যায়
- মোটিলিটি (চলাচলের গতি) দুর্বল হয়
- মর্ফোলজিক্যাল ত্রুটি (আকার/আকৃতি বিকৃত)
- ডিএনএ ফ্র্যাগমেন্টেশন বেড়ে যায়
নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য প্রতিকার ও প্রতিরোধ
পর্যাপ্ত (৭–৯ ঘণ্টা) গভীর ঘুম নিশ্চিত করুন
ঘুমের নির্দিষ্ট সময় বজায় রাখুন
ঘুমের আগে ক্যাফেইন, স্ক্রিন টাইম ও মানসিক উত্তেজনা পরিহার করুন
স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট করুন (ধ্যান, ব্যায়াম, প্রার্থনা)
প্রয়োজনে ঘুম বিশেষজ্ঞ বা ইউরোলজিস্টের পরামর্শ নিন
উপসংহার
অনিদ্রা পুরুষের প্রজনন ক্ষমতায় এক নীরব ঘাতকের মতো কাজ করে। এটি হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে, শুক্রাণু উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটায় এবং গুণমান কমিয়ে দেয়। তাই, যারা পিতৃত্ব পরিকল্পনা করছেন বা সন্তান নিতে চান, তাদের জন্য ঘুম শুধুই আরামের বিষয় নয়—এটি প্রজনন সক্ষমতার একটি অপরিহার্য উপাদান।