Blog
দীর্ঘদিন ঘুমের ওষুধ সেবনের মারাত্মক কুফল: একটি বিশদ বিশ্লেষণ !

ঘুমের সমস্যা বা ইনসোমনিয়া (Insomnia) আধুনিক জীবনের একটি সাধারণ সমস্যা। এর দ্রুত সমাধান হিসেবে অনেকেই চিকিৎসকের পরামর্শে বা নিজে থেকেই ঘুমের ওষুধের দিকে ঝোঁকেন। স্বল্পমেয়াদে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে এটি কার্যকরী হলেও, দীর্ঘদিন ধরে ঘুমের ওষুধ সেবন শরীর ও মনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। এর কুফলগুলো শুধুমাত্র শারীরিক নয়, বরং মানসিক, জ্ঞানীয় এবং আচরণগতও বটে।
বেশিরভাগ প্রচলিত ঘুমের ওষুধ, যেমন বেঞ্জোডায়াজেপিন (ডায়াজেপাম, আলপ্রাজোলাম) এবং জেড-ড্রাগস (জোলপিডেম, এসজোপিক্লোন), মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট রাসায়নিক বার্তাবাহক বা নিউরোট্রান্সমিটারের ওপর কাজ করে। এর নাম হলো গামা–অ্যামিনোবিউটারিক অ্যাসিড (GABA)।
কার্যপদ্ধতি: GABA হলো একটি ইনহিবিটরি বা নিবৃত্তিমূলক নিউরোট্রান্সমিটার। এর কাজ হলো মস্তিষ্কের কার্যকলাপকে ধীর করে দেওয়া, স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত করা এবং শরীরকে শিথিল করে ঘুমের জন্য প্রস্তুত করা। ঘুমের ওষুধগুলো এই GABA-এর কার্যকারিতা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়, ফলে মস্তিষ্ক কৃত্রিমভাবে শান্ত হয়ে যায় এবং ঘুম আসে।
সমস্যাটি কোথায়?:
- সহনশীলতা (Tolerance): একটানা ঘুমের ওষুধ ব্যবহার করলে আমাদের মস্তিষ্ক এই কৃত্রিম GABA উদ্দীপনার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়। ফলে, মস্তিষ্কের GABA রিসেপ্টরগুলো আগের মতো সংবেদনশীল থাকে না। এর পরিণতিতে, একই ডোজে আর কাজ হয় না এবং ঘুম আনার জন্য আরও বেশি ডোজের প্রয়োজন হয়। একেই “টলারেন্স” বা সহনশীলতা তৈরি হওয়া বলে।
- নির্ভরশীলতা (Dependence): সহনশীলতা তৈরির পরের ধাপই হলো নির্ভরশীলতা। এই পর্যায়ে, মস্তিষ্ক নিজে থেকে স্বাভাবিকভাবে ঘুমের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে না। ঘুমানোর জন্য সে পুরোপুরি ওষুধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এটি শারীরিক এবং মানসিক – উভয় প্রকারের হতে পারে।
- প্রত্যাহার (Withdrawal): নির্ভরশীলতা তৈরি হওয়ার পর হঠাৎ ওষুধ ছেড়ে দিলে বা ডোজ কমালে শরীর এবং মস্তিষ্কে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যেহেতু মস্তিষ্ক ওষুধ ছাড়া অচল হয়ে পড়েছিল, তাই ওষুধের অনুপস্থিতিতে এটি অতি-সক্রিয় (Hyperexcited) হয়ে ওঠে। এর ফলে আগের চেয়েও মারাত্মক অনিদ্রা (Rebound Insomnia), তীব্র উদ্বেগ, কাঁপুনি, এমনকি খিঁচুনি পর্যন্ত হতে পারে।
- Sleep Architecture Disruption (ঘুমের স্বাভাবিক গঠনে ব্যাঘাত): প্রাকৃতিক ঘুম বিভিন্ন স্তরের (যেমন: হালকা ঘুম, গভীর ঘুম, REM ঘুম) মধ্যে দিয়ে যায়। গভীর ঘুম (Deep Sleep) এবং REM ঘুম শরীর ও মনের পুনর্গঠনের জন্য অপরিহার্য। ঘুমের ওষুধ, বিশেষ করে বেনজোডায়াজেপিন, গভীর ঘুম এবং REM ঘুমের পরিমাণ ও গুণমান কমিয়ে দেয়। ফলে, ৮ ঘণ্টা ঘুমানোর পরেও শরীর সতেজ লাগে না এবং স্মৃতি ও শেখার প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে।
দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারের কুফলসমূহ (তথ্য ও প্রমাণসহ)
১. জ্ঞানীয় ক্ষমতা হ্রাস (Cognitive Decline)
দীর্ঘদিন ঘুমের ওষুধ ব্যবহারে স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- দিনের বেলায় ঘুম ঘুম ভাব ও সমন্বয়হীনতা: ঘুমের ওষুধের প্রভাব ৮-১২ ঘণ্টা পর্যন্ত থাকতে পারে। ফলে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরও এর রেশ থেকে যায়, যাকে “হ্যাঙ্গওভার এফেক্ট” বলে। এর কারণে দিনের বেলায় মনোযোগ কমে যায়, কাজে ভুল হয় এবং গাড়ি চালানো বা মেশিন পরিচালনার সময় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়।
- স্মৃতিভ্রংশ (Amnesia): বিশেষ করে জেড-ড্রাগস (যেমন জোলপিডেম) “অ্যান্টেরোগ্রেড অ্যামনেশিয়া” তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ, ওষুধ খাওয়ার পর থেকে ঘুমিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত যা কিছু ঘটে, তা পরে আর মনে থাকে না।
- ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশের ঝুঁকি বৃদ্ধি: বেশ কিছু গবেষণায় দীর্ঘদিন বেঞ্জোডায়াজেপিন জাতীয় ঘুমের ওষুধ সেবনের সাথে ডিমেনশিয়া বা আলঝেইমার্স রোগের ঝুঁকি বাড়ার একটি সম্পর্ক পাওয়া গেছে। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল (BMJ)-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দীর্ঘদিন ধরে এই ওষুধ সেবন করেছেন, তাদের মধ্যে ডিমেনশিয়া হওয়ার ঝুঁকি প্রায় ৫১% বেশি।
২. মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি
ঘুমের ওষুধ বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
- বিষণ্ণতা: ঘুমের ওষুধ মস্তিষ্কের স্বাভাবিক রাসায়নিক ভারসাম্যকে নষ্ট করে দেয়, যা আবেগ নিয়ন্ত্রণের জন্য জরুরি। এটি নতুন করে বিষণ্ণতা তৈরি করতে পারে বা আগের বিষণ্ণতাকে আরও তীব্র করে তুলতে পারে।
- আবেগীয় অসাড়তা (Emotional Blunting): অনেক ব্যবহারকারী জানান যে, এই ওষুধগুলো তাদের আবেগ অনুভূতিকে ভোঁতা করে দেয়। তারা আনন্দ বা দুঃখ কোনোটিই আগের মতো অনুভব করতে পারেন না।
৩. শারীরিক ঝুঁকি
- পড়ে গিয়ে আঘাতের ঝুঁকি: ঘুমের ওষুধের কারণে সৃষ্ট মাথা ঘোরা এবং সমন্বয়হীনতার জন্য, বিশেষ করে বয়স্কদের মধ্যে, রাতে বা সকালে পড়ে গিয়ে হাড় ভাঙার (যেমন হিপ ফ্র্যাকচার) ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
- শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা: ঘুমের ওষুধ, বিশেষ করে বারবিচুরেটস এবং বেঞ্জোডায়াজেপিন, শ্বাস-প্রশ্বাসকে ধীর করে দেয়। যাদের স্লিপ অ্যাপনিয়া বা ফুসফুসের অন্য কোনো রোগ (যেমন COPD) আছে, তাদের জন্য এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে, এমনকি ঘুমের মধ্যে মৃত্যুও ঘটাতে পারে।
৪. প্যারাসমনিয়া (Parasomnia)
এটি একটি বিপজ্জনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। এক্ষেত্রে ব্যবহারকারী ঘুমের মধ্যেই বিভিন্ন জটিল কাজ করে বসেন, যা পরে তার মনে থাকে না। যেমন:
- ঘুমের মধ্যে হাঁটা (Sleepwalking)
- ঘুমের মধ্যে খাওয়া (Sleep-eating)
- ঘুমের মধ্যে গাড়ি চালানো (Sleep-driving)
- ঘুমের মধ্যে যৌন কার্য কলাপে লিপ্ত হওয়া (Sexsomnia)
এই ঘটনাগুলো কেবল ব্যবহারকারীর জন্যই নয়, তার আশেপাশের মানুষের জন্যও মারাত্মক বিপজ্জনক।
৫. রিবাউন্ড ইনসমনিয়া (Rebound Insomnia)
ওষুধ ছাড়ার চেষ্টা করলে অনিদ্রার সমস্যাটি আগের চেয়েও ভয়াবহ রূপে ফিরে আসে। মস্তিষ্ক ওষুধের ওপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়ে যে, ওষুধ ছাড়া সে শান্ত হতে পারে না, ফলে ঘুম পুরোপুরি উধাও হয়ে যায়। এই ভয়ে অনেকেই আর ওষুধ ছাড়তে পারেন না এবং এক দুষ্ট চক্রে আটকে পড়েন।
বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি
ডঃ ম্যাথিউ ওয়াকার (Dr. Matthew Walker), ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসায়েন্স এবং সাইকোলজির অধ্যাপক এবং “Why We Sleep” বইয়ের লেখক বলেন, “ঘুমের ওষুধ প্রাকৃতিক ঘুম প্রদান করে না। এটি মস্তিষ্ককে এক প্রকার অবশ বা সিডেট (Sedate) করে রাখে। সিডেশন আর ঘুম এক জিনিস নয়। এই ওষুধগুলো ঘুমের গভীর এবং পুনরুদ্ধারকারী পর্যায়গুলোকে (Deep NREM and REM sleep) বাধাগ্রস্ত করে, যা স্মৃতি এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য।”
ম্যাথিউ ওয়াকার (Matthew Walker) তাঁর “Why We Sleep” বইয়ে অন্য অধ্যয়ে বলেন, “ঘুমের ওষুধ প্রাকৃতিক ঘুমকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না। এটি মস্তিষ্ককে এক ধরনের অবশ বা অচেতন করে রাখে, যা থেকে প্রাপ্ত বিশ্রাম আসল ঘুমের মতো পুনরুজ্জীবিতকারী নয়।”
আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ স্লিপ মেডিসিন (AASM) দীর্ঘস্থায়ী অনিদ্রার প্রথম এবং প্রধান চিকিৎসা হিসেবে ঘুমের ওষুধের পরিবর্তে কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি ফর ইনসোমনিয়া (CBT-I)-এর সুপারিশ করে। তাদের মতে, ওষুধ কেবল একটি সাময়িক সমাধান, যা সমস্যার মূল কারণকে সমাধান করে না।
যুক্তি দিয়ে সারসংক্ষেপ
১. উপসর্গ চাপা দেওয়া, সমাধান নয়: ঘুমের ওষুধ অনিদ্রার মূল কারণ (যেমন: উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, ভুল জীবনযাত্রা) এটি কেবল উপসর্গটিকে সাময়িকভাবে চাপা দেয়। এটি অনেকটা ভাঙা পায়ের ওপর ব্যথানাশক লাগিয়ে দৌড়ানোর চেষ্টার মতো।
২. প্রাকৃতিক ঘুমের বিকল্প নেই: ঘুমের ওষুধ মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ঘুমের চক্রকে (Sleep Architecture) ব্যাহত করে। প্রাকৃতিক ঘুমের মাধ্যমে আমাদের মস্তিষ্ক ও শরীর যেভাবে পুনর্গঠিত ও সতেজ হয়, ওষুধের ঘুম তা করতে পারে না।
৩. ঝুঁকির পাল্লা ভারী: স্বল্পমেয়াদী সুবিধার চেয়ে দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট নির্ভরশীলতা, জ্ঞানীয় অবক্ষয়, মানসিক ও শারীরিক ঝুঁকির পাল্লাই অনেক বেশি ভারী।
উপসংহার ও পরামর্শ
ঘুমের ওষুধ একটি ধারালো ছুরির মতো, যা সঠিক তত্ত্বাবধানে জীবন রক্ষাকারী হতে পারে, কিন্তু ভুল ব্যবহারে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া বা একটানা কয়েক সপ্তাহের বেশি ঘুমের ওষুধ সেবন করা উচিত নয়।
অনিদ্রার স্থায়ী সমাধানের জন্য ওষুধের ওপর নির্ভর না করে স্লিপ হাইজিন (যেমন: নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানো ও ওঠা, শোবার ঘর অন্ধকার ও শান্ত রাখা, ঘুমানোর আগে স্ক্রিন পরিহার), ব্যায়াম, ধ্যান এবং CBT-I-এর মতো অবৈষয়িক পদ্ধতিগুলোর সাহায্য নেওয়া অনেক বেশি কার্যকর এবং নিরাপদ। যদি ঘুমের সমস্যা তীব্র হয়, তবে অবশ্যই একজন ঘুম বিশেষজ্ঞ বা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে এর মূল কারণ নির্ণয় ও সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করা অপরিহার্য।