Blog
বিছানায় গেলেও ঘুম আসে না ? কারণ অতিরিক্ত চিন্তা আর মানসিক চাপ !

রাত হয়েছে অনেকক্ষণ, বিছানায় গিয়েছেন সময়মতো। ঘর নিঃশব্দ, আলো নিভে গেছে, মোবাইলও দূরে রেখে দিয়েছেন। কিন্তু ঘুম? সে যেন আপনাকে এড়িয়ে চলছে! এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি আজকাল অনেকেই হন, বিশেষ করে কর্মব্যস্ত, উচ্চচিন্তাশীল বা আবেগপ্রবণ মানুষরা। গবেষণা বলছে, ঘুম না আসার পেছনে অন্যতম বড় কারণ হলো ওভারথিংকিং (অতিরিক্ত চিন্তা), স্ট্রেস (মানসিক চাপ) এবং দুশ্চিন্তা।
এই সমস্যাগুলো শুধু এক রাতের ঘুম নষ্ট করে না, বরং ধীরে ধীরে ঘুমের গুণগত মান কমিয়ে দেয় এবং মানসিক-শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলে।
ঘুম এবং মানসিক চাপ: সম্পর্ক কী?
ঘুম ও মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পর্ক জটিল এবং একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। মানসিক চাপ বাড়লে ঘুম কমে যায়, আবার পর্যাপ্ত ঘুম না হলে মানসিক চাপ আরও বেড়ে যায়—এ যেন এক বন্ধ ঘূর্ণিচক্র!
যুক্তরাষ্ট্রের Sleep Foundation-এর মতে, উদ্বেগ এবং স্ট্রেস শরীরে কর্টিসল নামক একটি স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা মস্তিষ্ককে “সতর্ক” অবস্থায় রাখে এবং ঘুমের প্রাকৃতিক চক্র ব্যাহত করে। ফলে বিছানায় গেলেও মস্তিষ্ক শান্ত হয় না, এবং আপনি নানা চিন্তায় ডুবে যান।
ওভারথিংকিং কিভাবে ঘুম নষ্ট করে?
ওভারথিংকিং হলো এমন একটি মানসিক অবস্থা, যেখানে মানুষ একটানা কোনো একটি ঘটনা, সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ, বা কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে চিন্তা করে যায়। এই চিন্তাগুলো সাধারণত নেতিবাচক এবং অপরাধবোধ বা ভয়ভীতির সঙ্গে যুক্ত।
যখন আমরা শুয়ে পড়ি, তখন বাইরের ব্যস্ততা বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক তখনই আমাদের মস্তিষ্কের ‘চিন্তামঞ্চ’ সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই সময়েই “আমি যদি এটা না পারি?”, “কাল কী হবে?”, “আমার ভুলটা ঠিক হবে তো?”—এমন অসংখ্য চিন্তা মাথায় আসে। এতে করে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, স্নায়ু উত্তেজিত হয়, আর মস্তিষ্ক ঘুমের জন্য প্রস্তুত হতে পারে না।
ঘুম না আসার স্বাস্থ্যঝুঁকি
নিয়মিত ঘুম না হওয়া মানেই শুধু সকালবেলা ক্লান্ত থাকা নয়। বরং দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব মারাত্মক হতে পারে, যেমন:
- মানসিক রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি (ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি)
- স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যাওয়া
- ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হওয়া
- রক্তচাপ বৃদ্ধি ও হৃদরোগের সম্ভাবনা
- ওজন বৃদ্ধি এবং হরমোন ভারসাম্য নষ্ট হওয়া
সুতরাং, ঘুমের অভাব মানে শুধু আরামহীন রাত নয়—এটা একটি স্বাস্থ্যঝুঁকির সংকেত।
সমাধানের উপায় কী?
ঘুমের সমস্যা সমাধানে ওভারথিংকিং ও মানসিক চাপ কমানোর কার্যকর কিছু উপায় রয়েছে। নিচে উল্লেখযোগ্য কিছু পরামর্শ দেওয়া হলো:
১. নিয়মিত রুটিন মেনে চলা
প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় ঘুমাতে যাওয়া এবং ঘুম থেকে ওঠা শরীরের অভ্যন্তরীণ ঘড়িকে (circadian rhythm) নিয়ন্ত্রণে রাখে।
২. ঘুমের আগে স্ক্রিন টাইম কমানো
মোবাইল, ট্যাব বা ল্যাপটপের নীল আলো মেলাটোনিন হরমোনের ক্ষরণ কমিয়ে দেয়, যা ঘুমে বাধা সৃষ্টি করে।
৩. শরীরচর্চা ও মেডিটেশন
নিয়মিত ব্যায়াম ও মেডিটেশন স্নায়ুকে শান্ত করে এবং স্ট্রেস হরমোন কমায়, যার ফলে ঘুম সহজ হয়।
৪. জার্নালিং বা লেখা
দিনশেষে কয়েকটি চিন্তা কাগজে লিখে ফেললে মাথা অনেকটা হালকা লাগে। এতে ওভারথিংকিং কিছুটা কমে যায়।
৫. প্রাকৃতিক সাপ্লিমেন্ট বা হার্বাল সমাধান
ল্যাভেন্ডার, ক্যামোমাইল চা, ম্যাগনেশিয়াম, ভ্যালেরিয়ান রুট বা অশ্বগন্ধার মতো প্রাকৃতিক উপাদান ঘুমে সহায়তা করতে পারে।
৬. পেশাদার পরামর্শ গ্রহণ
যদি এই সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বা স্লিপ থেরাপিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
শেষ কথা
“ঘুম একমাত্র ওষুধ, যা বিনামূল্যে পাওয়া যায় কিন্তু আমরা অনেকেই তা নিতে পারি না।”
এই কথাটি আজকের সময়ের জন্য একদম প্রযোজ্য। ওভারথিংকিং, স্ট্রেস আর দুশ্চিন্তার পেছনে ছোটার এই দৌড়ে আমরা আমাদের শরীর ও মনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন—ঘুম—কে উপেক্ষা করছি।
জীবনে সাফল্য ও সুস্থতা চাইলে মানসিক শান্তি অর্জনের পাশাপাশি ঘুমের উপর গুরুত্ব দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। মনে রাখুন, ভালো ঘুম মানেই ভালো স্বাস্থ্য, ভালো মনোভাব এবং ভালো জীবন।